আজ থেকে ২৪ বছর আগে এই রিপোর্টটি করেছিলাম। তখন এটি ছিল দেশের সর্বাধিক আলোচিত প্রতিবেদন। সাপ্তাহিক যায় যায় দিন আমার এই রিপোর্টটিকে সপ্তাহ সেরা হিসাবে উল্লেখ করেছিল তাদের পত্রিকায়।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পর তদানীন্তন লীগ সরকার তাদের ট্রাডিশনাল মিত্র রাশিয়া থেকে পুরনো মিগ-২৯ জঙ্গী বিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।বিমান বাহিনীর অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা এই বিমান সংগ্রহের বিরোধিতা করেন। ডিজিএফআইও তাদের রিপোর্টে মিগ-২৯ ক্রয় ঠিক হবে না বলে উল্লেখ করে। সে সময় আমি আরেকটি দৈনিকে সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করি।
একদিন আমার নামে একটি খাম এলো ডাকে। খুলে দেখি সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙ্গে যাবার পর যেসব মিগ-২৯ ডাম্প করা হয়েছিল সেসব থেকে এক স্কোয়াড্রন নিয়ে আসার পায়তারা করছে সরকার। সেখানে দুর্নীতির বিষয়টিও ভালোভাবে উল্লেখ ছিল। সম্পাদককে ওই গোপন প্রতিবেদনটি দেখানোর পর তিনি বললেন যে আমি যেন আরো খোঁজ খবর নিয়ে রিপোর্ট করি। করলাম। শীর্ষ রিপোর্ট হলো আমার প্রতিবেদন। চারদিকে আলোচনা শুরু হলো রাশিয়ার ওই বস্তাপচা মিগ-২৯ কেনা নিয়ে, ওই ক্রয়ে দুর্নীতি নিয়ে।আমাকে অজ্ঞাত স্থান থেকে হুমকিও দেয়া হলো। সরকার কিনে নিয়ে আসলো মিগ-২৯।
এরপর দৈনিক ইনকিলাবে যোগ দিলাম রিপোর্টিং বিভাগে। সেখানে যাওয়ার পর আরো তথ্য পেতে শুরু করলাম মিগ-২৯ নিয়ে। ২০০১ সালের মে মাসে এই রিপোর্টটি করার পর বিমান বাহিনীর গোয়েন্দা অধিদপ্তর ডেকে নিয়ে গেল বিমান বাহিনী সদর দপ্তরে। কোথা থেকে তথ্য পেলাম জানতে চাইলেন পরিচালক। আমি যেহেতু একসময় সেনাবাহিনীতে ছিলাম তাই গিয়েছি, যেটা সাংবাদিক হিসাবে যেতে বাধ্য ছিলাম না। যাহোক, কোন তথ্য তাদের দেইনি।
পরবর্তিতে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা গেল মিগ-২৯ নিয়ে আরো সমস্যা। এর স্পেয়ার পার্টস সংগ্রহ জটিল হয়ে দাড়ালো। দুর্নীতি দমন ব্যুরো শেখ হাসিনা সহ ব্যবসায়ী নুর আলীর নামে দুর্নীতির মামলা দায়ের করলো।
এদিকে বিমান স্বল্পতা ও অপারেশনাল বিষয়াদি বিবেচনা করে তখন তড়িঘড়ি করে চীন থেকে নতুন এফ-৭ বিজি বিমান সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হলো। ২০০৫-৬ সালের মধ্যে এলো ১৬টি বিমান। এরপর ধাপে ধাপে আরো এসেছে। এছাড়া আগের সংগৃহিত পুরনো মডেলের এফ-৭ ও রয়ে গেল আমাদের বিমান বাহিনীতে।
২০০৯ এ ক্ষমতায় এসে লীগ আবারো ঝুকলো তাদের পরম বন্ধু রাশিয়ার দিকে। নিয়ে এলো ১৬ টি ট্রেইনার কাম গ্রাউন্ড এ্যাটাক বিমান ইয়াক-১৩০। তবে এগুলোতে এভিয়নিক্সসহ অন্যান্য অনেক কিছুরই ঘাটতি ছিল। রাশিয়ানরা মায়ানমারকে এসইউ-৩০, ইয়াক-১৩০ দিয়েছে। তারা আশা করেছিল বাংলাদেশ অন্তত এসইউ -২৭ নিবে। তাই কিছুটা শর্ত ছিল ইয়াক নেয়ার ক্ষেত্রে।
এর মধ্যে ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করে নিলে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে রাশিয়া থেকে কোন কিছু সংগ্রহ দুরূহ হয়ে পড়ে।
১৬ টি ইয়াক-১৩০ র মধ্যে ৪ টি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়েছে। পাইলট নিহত হয়েছেন।
এদিকে সেনাবাহিনীতেও রাশিয়ার তথাকথিত এক বিলিয়ন ডলারের লোন প্রটোকলের আওতায় ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এগুলোর লঞ্চার আসার পর পর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হওয়ার আর মিসাইল আসেনি! রাশিয়া প্রেম তাও যায়নি। কারন ওরা নির্বাচন এলেই লীগকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে যেতো যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য! ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পরও দেখা গেছে এদেশের অনেক মানুষ রাশিয়া রাশিয়া করে মাতম করছে!
আমাদের বিমান বাহিনীর চতুর্থ জেনারেশন জঙ্গী বিমান নেই। গত কয়েক বছর সেসময়কার বিমান বাহিনী প্রধানগন ও সরকার এনিয়ে কিছু করেনি। হেলিকপ্টার পাইলট বিমান বাহিনী প্রধান হয়েছেন। তিনি কন্সট্রাকশন ও বিউটিফিকেশনে বিশেষ নজর দিয়েছেন। কিসের জন্য, কার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য মাল্টিরোল ফাইটার কিনবেন? কিনেননি!
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে আকসা ও জিসুমিয়া চুক্তি স্বাক্ষরের অফার দেয়। সম্ভবত একমাত্র আমার সম্পাদিত ডিফেন্স জার্নালেই তাদের স্থানীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ও পলিটিক্যাল কাউন্সিলর অফিসিয়াল সাক্ষাতকার দিয়ে জানান যে তারা বাংলাদেশকে এফ-১৬ জঙ্গী বিমান ও এ্যাপাচে এ্যাটাক হেলিকপ্টার দিতে রাজি আছেন যদি বাংলাদেশ ওই দু’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। পাকিস্তান বহু আগেই এসবে স্বাক্ষর করেছে। আমাদের চেতনা জেগে ওঠে বারবার! আমরা স্বাক্ষর করিনি, হয়তো করবোও না। আর এই দু’টি চুক্তিতে স্বাক্ষর না করলে মার্কিন কোন ভারী সমরাস্ত্র পাওয়া যাবে না। পুরনো পরিবহন বিমান বা হেলিকপ্টার পাওয়া যেতে পারে মাত্র।
মজার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশকে যখনি আমেরিকা কোন কিছু অফার করে তখনি ভারত ও চীনের যতো প্লাটফর্ম আছে সেগুলো একযোগে গেল গেল সুর তোলে বাংলাদেশে। কি কমিউনিস্ট, কি ধর্মীয় কিছু গোষ্টি- সব মার্কিন বিরোধি জিগির তোলে। এই দুটি দেশ যে কখনোই বাংলাদেশে মার্কিন বা পশ্চিমা কোন ভালো সমরাস্ত্র আসতে দিবে না সেটা এরা আর বুঝতে পারে না। চারদিকে শোনা যায় সেন্ট মার্টিন নিয়ে গেল! আমরা হয়তো কোন কালেই আর এফ ১৬ বা এরকম আধুনিক কোন বিমান আনতে পারবো না। অথচ আমাদের যদি অল্প বিস্তর হলেও পশ্চিমা বিমান থাকে তাহলে তা ব্যালেন্স অফ পাওয়ার রক্ষায় কার্য়কর ভূমিকা পালন করতে পারে। পাকিস্তান তাই করছে। ১৪০ টার মতো এফ-১৬ তাদের দিয়েছে ব্যাপক ডিফেন্সিভ ক্ষমতা।
আমরা যদি হুজুগ, আবেগ তাড়িত হয়ে উন্নত পশ্চিমা বিমান না আনি তাহলে ক্ষতিটা আমাদেরই। লাভ ভারত ও চীনের। কিন্তু আমরা তো চীনকে বাদ দিতে চাই না। তাদের কাছ থেকে আমাদের অস্ত্র, বিমান আনতেই হবে। সম্পর্কটা গাড় করতে হবে। তবে এজন্য মার্কিনীদের শত্রু বানিয়ে নয়, জিগির তুলে নয়।
চীন থেকে আমাদের আনতে হবে জে-১০ মাল্টি রোল ফাইটার।এফ-৭ গুলোর প্রতিস্থাপন হবে কি দিয়ে? পাকিস্তান তো জেএফ-১৭ দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে। আমরা কি দিয়ে করবো? বিমান বাহিনীর কর্তারাই তা বের করবেন।
জঙ্গী বিমান রক্ষণাবেক্ষণ, ওভারহলিংয়ের আধুনিক ব্যবস্থাপনা গড়তেও তো সময় ও অর্থ লাগে অনেক। আমাদের বিমান বাহিনীকে কি সে পরিমান অর্থ দিচ্ছে সরকার? না।
এছাড়া আছে বোমা, মিসাইল, স্পেয়ার পার্টস ক্রয়ের বিষয়টি। এগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। অর্থ ছাড়া আবার কিছুই হবে না। বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো জঙ্গী বিমান বানাতে পারবে না, ওই চেষ্টা করাটাও অপচয় ও সময়ের অপব্যবহার হবে। সেটা করার প্রয়োজনীয়তাও নেই।
পুরনো, মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তি নির্ভর এফ-৭ দিয়ে আর কতো কাল? চীনা বিমান বাহিনীতে এগুলো এখন ব্যবহার করা হয় না। পাাকিস্তান ফেইস আউট করছে। মিগ-২১ বিমানের মডেলকে ধরে চীনারা এই এফ-৭ বিমান তৈরি করে। ভারত ইসরাইল ও ফরাসী সহায়তায় আপগ্রেড করে এখনো অবশ্য মিগ-২১ বিমান পরিচালনা করছে। সেদেশে এই মিগ-২১ কে বলা হয় ফ্লাইং কফিন, উইডো মেকার। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতেও এফ-৭ অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। মারিয়াম মুক্তার নামে একজন বিখ্যাত নারী পাইলট এমন এক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন।
গত ২০ জুলাই ঢাকায় যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে এফ-৭ বিমানের তার আগেও এই বিমান ধ্বংস হয়ে আরো পাইলট নিহত হয়েছেন। কয়েক বছর আগে বার্ষিক মহরার সময় মেয়াদোর্ওীর্ণ মিসাইল ছুড়তে গিয়ে একজন উইং কমান্ডার নিহত হন। আমাদের এফ-৭ গুলোর কোন বিভিআর ( বিয়ন্ড ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ) ক্যাপাবিলিটি নেই। কোন আধুনিক এভিয়নিক্স নেই। যেভাবেই হোক বিমান বাহিনীকে সাজাতে হবে এবং তা হতে হবে খুব দ্রুত।
মাইলস্টোন স্কুলের দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। এনিয়ে ষড়যন্ত্র ত্বত্ত না খুঁজে বাস্তব সম্মত চিন্তা করাটাই হবে শ্রেয়। আশা করবো সরকার বিমান বাহিনীকে পর্যাপ্ত বাজেট দিবেন ও আমাদের বিমান বাহিনী তার সদব্যবহার করবে।
(ফেসবুক ওয়াল থেকে)
খুলনা গেজেট/এনএম